কুরবানীর ইতিহাস: ইসলামের আলোকে
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আজকে আমরা জানব ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত কুরবানীর ইতিহাস ও শিক্ষা সম্পর্কে। এই ইবাদতটি ইসলামে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ এবং মহান ত্যাগের প্রতীক।
☪️ পৃথিবীতে প্রথম কুরবানীর ইতিহাস: হাবীল ও কাবীলের ঘটনা
আজকে আমরা জানবো কুরবানীর ইতিহাস সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ফজিলতের এবাদত হল কোরবানি কয়েকদিনের ভিতরেই চলে আসবে ইনশাল্লাহ ইসলামী ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানী কোথায় ছিল সেই সম্পর্কে আগে আমরা জানবো, হযরত আদম আলাইহিস সালাম হাওয়া আলাইহিস সালামকে যখন আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর বুকে পাঠায় পৃথিবীর বুকে ঐ পরিমান মানুষ ছিল না, তখন আদম আলাইহিস সালাম হাওয়া আলাইহিস সালামের মাধ্যমে আল্লাহতালা দুনিয়ার বুকে সন্তান পাঠাইতেন জোড়ায় জোড়ায় আর ঐ সন্তানগুলো থেকে ১ম এবং দ্বিতীয় যারা থেকে জোড়াগুলো ভাঙ্গীয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দেওয়া হতো, এরকম ভাবেই আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে আদেশ করেছিলেন, আর তিনি এই ভাবেই কাজ করতে ছিলেন, একটা সময় দেখা গেল হাবিল এবং কাবিল নামে দুইটা সন্তানকে আল্লাহতালা পৃথিবীর বুকে পাঠাইলেন, তো হাবিল এর সাথে যেই মেয়েটা পৃথিবীর বুকে আসছিল সেই মেয়েটা সেই পরিমাণ সুন্দরী ছিল না কুশ্রী ছিল বা কালো ছিল, কিন্তু কাবিদের সাথে পৃথিবীর বুকে যে মেয়েটা এসেছিল সেই মেয়েটা ছিল অত্যান্ত সুন্দরী দেখতে সুদর্শন, যখন হাবিল এবং কাবিলের বিবাহের বয়স পর্যন্ত সীমা পৌঁছে যায়, এই অবস্থার মধ্যে হযরত আদম আলাইহিস সালাম দুই ভাইয়ের কাছে বিবাহের প্রস্তাব প্রেরণ করা করেন, হাবিল সেটাকে স্বাচ্ছন্দে গ্রহণ করে নেয় কিন্তু কাবিল কোনভাবেই সেটা মানতে পারতেছিল না, একটা পর্যায়ে কাবিল হযরত আদম আলাইহিস সালামকে বলেন যদি বিবাহ করতে হয় সুন্দরী যে রমণীটা আমার সাথে পৃথিবীর বুকে এসেছে তাকেই বিবাহ করব, আদম আঃ সালাম অনেকটাই বুঝাইলেন যে তোমার সঙ্গে পৃথিবীর বুকে যে মেয়েটা এসেছে, এটা তোমার আপন বোন, বিধায় একে তুমি বিবাহ করতে পারবা না কিন্তু কাবিল কোনভাবেই এই জিনিসটা মানতে ছিল না, একটা অবস্থার মধ্যে হযরতে আদম আলাইহিস সালাম দুই ভাইকে আদেশ করলো যে তোমরা কুরবানী করো যার কুরবানীটা আল্লাহ তা’আলা গ্রহণ করবে তার সঙ্গেই ওই মেয়েটার বিবাহ দেওয়া হবে, যেভাবে কুরআনের ভাষায় এসেছে
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَاناً فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ- لَئِنْ بَسَطتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِيْ مَا أَنَاْ بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لَأَقْتُلَكَ إِنِّيْ أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِيْنَ-
‘হে রাসূল! আপনি তাদেরকে আদমের পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়েই কুরবানী করেছিল, তখন একজনের কুরবানী কবুল হ’ল এবং অন্যজনের কুরবানী কবুল হ’ল না। সে (কাবীল) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন (হাবিল) বলল, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের কুরবানী কবুল করেন। সে (হাবিল) বলল, যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার প্রতি হস্ত প্রসারিত করব না। কেননা আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি’ (মায়েদা ২৭-২৮)।
যদিও হযরত আদম আলাইহিস সালাম চিন্তা করতেছিল বা ভেবেছিল যে আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই হাবিলের কুরবানীটাই গ্রহণ করবেন কেননা আল্লাহ তাআলা এমনটাই আদেশ করেছিলেন, একটা অবস্থায় বাবা আদম আলাইহিস সালামের কথা মত হাবিল এবং কাবিল কুরবানী করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করল হাবিল এর কাছে প্রচুর পরিমাণ পশু ছিল তার নিকট থেকে সবচাইতে সুন্দর বা সুদর্শন সবচাইতে হষ্টপুষ্ট যে পশুটা ছিল সেটা আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় কুরবানী করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করল, আর কাবিল এর কাছে প্রচুর পরিমাণ জমাজমি ছিল তার ক্ষেতের মধ্যে থেকে কিছু ফসল নিয়ে কুরবানী করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করল, হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর আদেশে তারা কুরবানী করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলো এবং একটা জায়গাতে গিয়ে রেখে চলে আসলো আল্লাহ তাআলা হাবিলের কুরবানিটা গ্রহণ করল কাবিলের কুরবানী টা গ্রহণ করলেন না, আর এটাই ছিল পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম কুরবানীর ইতিহাস।
আর আমরা যেটাকে অনুসরণ করে কুরবানী করে থাকি এটা হল হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে অনুসরণ করে কুরবানী করে থাকি, একদিন সাহাবায়ে কেরাম রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন রসুল কুরবানীর মানে কি তখন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন কুরবানী হল হযরত ইব্রাহিম আঃ এর অনুসরণ করে তোমরা কুরবানী করতে থাকো, হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের সুন্নত, তো আমরা ওই অনুসরণ করে কুরবানী করে থাকি ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এমন একটা নবী ছিলেন যে পৃথিবীর বুকে আসার পর থেকেই সব সময় জন্য তিনি পরীক্ষার সম্মুখীন হতেন, পৃথিবীর বুকে আসার পর হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তা’আলা অনেকগুলো পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন, তার ভিতর থেকে সব চাইতে কঠিন পরীক্ষা ছিল যে আল্লাহ তায়ালা তাকে সন্তান দান করেন, যখন তার বয়স ছিল ৮৬ বছর হয়েছিল, লাগাতার আল্লাহ তাআলার কাছে তিনি প্রত্যেকটা সময় দোয়া করতেন
رَبِّ هَبْ لِيْ مِنَ الصّٰلِحِيْنَ.
হে আমার রব! আমাকে নেক সন্তান দান করুন। –সূরা সাফফাত (৩৭) : ১০০
একটা সন্তানের জন্য, ৮৬ বছর বয়সে আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে একটা সন্তান দান করেন সন্তান পৃথিবীর বুকে আসার পর কিছুদিন পরে হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম কে আল্লাহ তার আদেশ করেন, তোমার সন্তান এবং বিবি হাজেরা আলাইহিস সালামকে তুমি মক্কার মধ্যে রেখে আসো, মক্কা এমন একটা জায়গা ছিল যেখানে কোন পানি বা খাবারের কোন বাসস্থান ছিল না, বা মানুষজন সেখানে বসবাস করত না, যাকে মরুভূমি বলা হতো, আল্লাহ তাআলার আদেশে হযরত আদম আলাইহিস সালাম বিবি হাজেরা এবং পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামকে সেখানে রেখে আসে, হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম যে পরিমাণ খাবার রেখে আসছিলেন, কিছুদিনের মধ্যেই খাবার শেষ হয়ে যায়, ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম যখন বিবি কে রেখে চলে আসতে ছিলেন, তখন তিনি ইব্রাহিম আঃ কে বারবার জিজ্ঞাসা করতে ছিলেন, তুমি আমাকে এখানে কেন রেখে যাচ্ছ, এই অবস্থায় শুধুমাত্র ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এতটুকুই বলেছিলেন যে আল্লাহ তা’আলা আদেশ করেছেন, বিধায় তোমাকে রেখে যাচ্ছি, দেখতে দেখতে হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম অনেকটাই বড় হয়ে যায় চোখের সামনে যতটাই বড় হতে ছিল হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের কাছে ততটাই প্রিয় হতে ছিল, একটা সময় হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম স্বপ্নের মধ্যে দেখল পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামকে তিনি কুরবানী করতেছে এই স্বপ্নটা দেখার পর হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ইসমাইল আলাইহিস সালামের নিকটে যায় এবং স্বপ্ন সম্পর্কে বিস্তারিত তার সন্তানকে জানায়, কোরআনের ভাষায় এসেছে
يٰبُنَيَّ اِنِّيْۤ اَرٰي فِي الْمَنَامِ اَنِّيْۤ اَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَا ذَا تَرٰي.
হে আমরা বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি, তোমাকে যবেহ করছি। তাই তুমি চিন্তা করে দেখ, তোমার অভিমত কী।
কিন্তু তিনি তো ছিলেন খলীলুল্লাহর পুত্র এবং ভাবী নবী। তিনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন–
يٰۤاَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِيْۤ اِنْ شَآءَ اللهُ مِنَ الصّٰبِرِيْنَ.
হে আমার পিতা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা করে ফেলুন। আপনি আমাকে আল্লাহ চাহেন তো অবশ্যই ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। –সূরা সাফফাত (৩৭) : ১০২
হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ইসমাইল আলাইহিস সালামকে বলতেছিল হে আমার পুত্র আমি স্বপ্নের ভিতর দেখেছি তোমাকে কুরবানী করতেছি , এই ব্যাপারে তোমারে পরামর্শটা কি হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম কোন প্রকার চিন্তা ব্যতীত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম কে বলে ফেললেন আপনি স্বপ্নের ভিতরে যা দেখেছেন আপনি বাস্তবায়ন করেন, অবশ্যই আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে হতেই পাবেন, হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম যেই এই কথাটা বলেছে কথা বলতে দেরি হয়েছে ছুরি চালাইতে দেরি হয় নাই, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা হযরতে ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের শুধুমাত্র অন্তরের পরীক্ষা করতে চাইছিলেন হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম সব চাইতে কাকে বেশি মহব্বত করেন, ছুরি যখন চালাইতেছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম কে জানানো হলো আপনি স্বপ্ন টাকে বাস্তবায়ন করেছেন, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একটা পশুর ব্যবস্থা করা হলো যেখানে ইসমাইল আলাইহিস সালামের পরিবর্তে সেই পশুটাকে কুরবানী করা হলো, এটা কে অনুসরণ করে এখন আমরা বর্তমানে কুরবানী করে থাকি।
☪️ কুরবানীর ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আল্লাহর কাছে পৌঁছে না পশুর মাংস বা রক্ত, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।”
(সূরা হজ্জ: ৩৭)
এই আয়াত স্পষ্ট করে দেয়, কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি। আমাদের উচিত কুরবানীকে শুধু সামাজিক বা লোক দেখানো উৎসবে পরিণত না করে, একে একান্তভাবে আল্লাহর জন্য করা।
কুরবানীর ইতিহাস থেকে মূল বার্তা:
আল্লাহর নির্দেশে আত্মসমর্পণ
ত্যাগের শিক্ষা
তাকওয়া অর্জনের মাধ্যম
আল্লাহর সন্তুষ্টিই চূড়ান্ত উদ্দেশ্য